Skip to main content

ছোটবেলায় নানা বাড়ির আনন্দ

 




ছোটবেলায় আমাদের নিজের জমি ছিল না। তাই স্কুল ছুটি হলে ডিসেম্বর মাসে মামাবাড়ি যেতাম। সেসব দিনগুলো যেন এক অন্যরকম স্বপ্ন ছিল। ধান মারার জন্য মাঠে গরু দিয়ে মাড়াই করা হতো। মাঠের মধ্যে “শাতল” বানানো হতো—ছোট ছোট ঘর বানানো, যেখানে দুপুরে লাড্ডু আর মুড়ি বিক্রি করতে লোক আসত। আমরা ধান দিয়ে লাড্ডু আর মুড়ি কিনে খেতাম। সেই স্বাদ আর আনন্দ আজও ভুলতে পারি না।


মামাবাড়ির একপাশে ছিল একটা ছোট্ট “বিছরা,” যেখানে নানি সুন্দরভাবে লাইন ধরে নানান রকমের সবজি লাগাতেন। আমরা সবাই মিলে মাটি কোপাতাম, গাছে পানি দিতাম। নানির সঙ্গে কাজ করতে করতেই শিখেছি প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার আনন্দ। মাঠের আশেপাশে ছোট ছোট গর্ত ছিল, যেখানে বর্ষায় মাছ ঢুকত। জল শুকিয়ে গেলে মামা সেই মাছ ধরতেন। তখন নানি সেই টাটকা মাছ দিয়ে বিছরার ফরাসি শাক তুলে রান্না করতেন। পেঁয়াজপাতা আর ধনিয়াপাতার সুগন্ধে সে তরকারি যে কী অসাধারণ ছিল! আজও সেই স্বাদ আর গন্ধ কোথাও পাইনি।


বড় মামা ছিলেন কেরাম খেলার শৌখিন। আমরা যখন তার জন্য মাটির চুলা থেকে বিড়ি জ্বালিয়ে নিয়ে আসতাম, পথে দু-একটা টান না মেরে থাকতে পারতাম না। শীতকালে বড়ই গাছ থেকে বড়ই পেরে সবাই মিলে বড়ই চাটনি বানিয়ে রোদে বসে খাওয়ার যে আনন্দ, সেটাকে আমরা তখন “ঠুবা” বলতাম। এখন তো জানি, সেটাই ছিল আমাদের ছোট্ট পিকনিক। ছোট মাসির ছেলেমেয়েরা এসে যোগ দিত, আর আমরা সবাই মিলে শীতলপাটিতে বসে দুপুরের ভাত খেতাম। সেই একসঙ্গে ভাত খাওয়ার আনন্দ কোনো পাঁচতারা হোটেলেও পাব না।


মামাবাড়ির মাটির ঘর, টিনের চাল, আর সেই সরল জীবন যেন এক টুকরো স্বর্গ ছিল। বড় মামা তখন বাজার থেকে ভাড়ায় টিভি আর সিডি নিয়ে আসতেন। সবার প্রিয় বাংলা সিনেমা— বেদের মেয়ে জোসনা, শিমুল পারুল, ঝিনুক মালা—সবাই মিলে রাত জেগে দেখতাম। হিন্দি সিনেমাও আনতেন, যেমন দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে। সেইসব সিনেমা দেখা ছিল আমাদের জীবনের এক বড় উৎসব। আজও পুরনো বাংলা সিনেমার গান শুনলে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।


শুধু শীতকালে নয়, জুন-জুলাই মাসে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষে মামাবাড়ি যেতাম। ধানক্ষেতে কাজ করতে নামতাম, যদিও আসলে কাজ কম, ধান নষ্ট করতেই বেশি আনন্দ পেতাম। তখন আনন্দটাই ছিল বড় কথা। মামাবাড়িতে গেলে রোজ তিন বেলা তো ভাত খেতামই, বড় মামা খেত থেকে এলে উনার পাশে বসে না খেলে চলতই না। তাই একদিনে ৪-৫ বেলাও ভাত খেতাম। এমনকি, চুঙার ভাত বানানোর মজাও ছিল আলাদা। কলাপাতার ভেতরে চাল ভরে পুড়িয়ে বানানো সেই চুঙার ভাত যেন একটা বিশেষ স্মৃতি।


আজ মামাবাড়ির সেই ছোট্ট পরিবার অনেক বড় হয়ে গেছে। ছোট মাসি, বড় মামা, ছোট মামারা এখন যার যার কাজে ব্যস্ত। তবে নানি এখনো ঠিক আগের মতোই ভালোবাসেন। মাসে দু-একবার আমাদের বাড়ি আসেন, আর তার সেই মাতৃসুলভ আদরে মনটা ভরে যায়। ছোটবেলায় নানি-মামাদের ভালোবাসার যে আশ্রয় পেয়েছি, তা জীবনের অন্য কোনো সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বড় মামা এখনো প্রতিটা সুখ-দুঃখের সময় পাশে থাকেন, যেন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।


আজ নানিকে ফোনে বলছিলাম, যদি আবার সেই “বিছরা” তৈরি করতেন, তাহলে আমিও এসে ফরাসি গাছে পানি দিতাম। এই ছোট্ট ইচ্ছেগুলো, এই স্মৃতিগুলোই বেঁচে থাকার প্রেরণা। ভালোবাসি নানি, মাসি, মামাদের, আর ভালোবাসি আমার সেই শৈশব, যা আমাকে এখনো তাড়িয়ে নিয়ে যায় সুখের অতীতে।


Comments