ছোটবেলায় শবে বরাত এলেই আমার দাদি বলতেন, "সিন্নি করতে হবে," আর নানা ধরনের শিন্নি করতেন। কখনো খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে শেয়ার করতেন, কখনো "আল্লাহর রহম শিন্নি" বানিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন। সেই দিনগুলো ছিল অন্য রকম। বাড়ির বড়রা আমাদের ছোটদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে যেতেন। তখন মসজিদে কারেন্ট ছিল না। শবে বরাতের রাতকে বলা হতো "বাতির রাত"। সবাই মসজিদে মোমবাতি আর আগরবাতি নিয়ে যেতেন। পুরো মসজিদের বাউন্ডারিতে মোমবাতি সাজিয়ে রাখা হতো। রাতের সেই আলোয় মসজিদ দেখতাম, যেন কোনো বিশেষ দিনে মন্দির সাজানো হয়েছে।
শবে বরাতের আগে ঘরে ঘরে শিন্নি বানানো হতো। শবে বরাতের রাতে এশার নামাজ শেষে মসজিদে বড় আয়োজন হতো। প্রত্যেক পরিবার থেকে শিন্নি আনা হতো এবং তা সবার মধ্যে ভাগ করা হতো। সেদিন মসজিদের পরিবেশটা ছিল একেবারে ভিন্ন। মহিলারা, আমাদের মা-দাদিরা, আশেপাশের চাচি-বোনেরা সারা রাত জেগে নামাজ পড়তেন। তারা বিশেষভাবে ১২ রাকাত নফল নামাজ পড়তেন, যাকে বলা হতো "লাইলাতুল বরাতের নামাজ"।
আরেকটি বিশেষ বিষয় ছিল, শবে বরাতের রাতে ঘরে ঘরে মাংস রান্না হতো। যে ঘরে মাংস না থাকত, সেখানেও সবাই মাংস পাঠাতো। সারারাত এবাদত করে সেহরি খেয়ে রোজা রাখার জন্য সবাই প্রস্তুত হতো। এমনকি যেসব মানুষ সাধারণত নামাজ পড়তেন না, তারাও সেদিন মসজিদে এসে এবাদতে অংশ নিতেন।
মসজিদে ছোট ছোট বাচ্চারা গজল গাইতো, কেরাত পড়তো। বড় মাওলানারা শবে বরাত উপলক্ষে ওয়াজ করাতেন। এই রাতেই মসজিদের বার্ষিক বাজেট নির্ধারণ করা হতো। সারা বছরের খরচ, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা—সব কিছু নিয়ে আলোচনা হতো। সবাই সেই সময় মসজিদের জন্য অর্থ সাহায্য করতেন। স্কুলে ছুটি থাকত, যেন সবাই মসজিদে গিয়ে এই রাত উদযাপন করতে পারে।
তখন না ছিল সোশ্যাল মিডিয়া, না ছিল ফেসবুক মুফতিরা, না ছিল ইসলামিক টিভি চ্যানেল। মসজিদের ইমাম সাহেব যা বলতেন, তাই করা হতো। আজ আমরা অনেক বেশি জানি, হয়তো গবেষণা করেছি। এখন অনেকে বলেন, শবে বরাত বলে কিছু নেই। "লাইলাতুল বরাত" বলে বিশেষ কোনো নামাজ নেই। এগুলোকে বেদাত বলে বাতিল করা হয়েছে।
কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন—যারা বেদাত জানতেন না, তারা হয়তো ভুলভ্রান্তি নিয়ে ইবাদত করতেন, কিন্তু তারা ইবাদত করতেন। আল্লাহর ঘরে যেতেন, সাধ্যমতো সিন্নি দিতেন, রোজা রাখতেন। আল্লাহর রহম এত বড় যে, অজান্তে করা সেসব ইবাদতও নিশ্চয়ই কবুল হবে। আজ আমরা যারা বেশি জানি, আমরা বেদাত-বেদাত করতে করতে অনেক ইবাদত থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা নিজেদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর জন্য মক্তব ত্যাগ করেছি। কিন্তু ফেসবুকে এসে বেদাত নিয়ে বড় বড় পোস্ট দিচ্ছি। অথচ নিজের ফরজ নামাজ আদায়ে অনেকেই অনিয়মিত।
আমরা রমজানে সেহরি-ইফতার নিয়ে খুব চর্চা করি, কিন্তু ভুলে যাই, রোজা শুধু উপোস থাকার নাম নয়। রোজা হলো চোখ, কান, হাত-পা—সবকিছুর সংযম। আসলে, আমরা যত বেশি জানি, তত বেশি ভুলে যাই।
পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। সেসব দিনগুলোতে শবে বরাত ছিল এক অন্য রকম অনুভূতির নাম। আজ আর সেই অনুভূতি আসে না। আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দিন, বেশি বেশি ইবাদতের তৌফিক দিন। যারা এই শবে বরাতে ইবাদত করবেন, তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ—দোয়াতে আমাকে স্মরণ করবেন।
আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন। আমিন।
Comments