Skip to main content

বরাক উপত্যকায় সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী: আমাদের করণীয়

 


বরাক উপত্যকায় সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী: আমাদের করণীয়

        

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে হয় কোনো না কোনো সড়ক দুর্ঘটনার খবর। কখনো একটি পরিবারের সবাই শেষ হয়ে যায়, কখনো পরিবারের একমাত্র সন্তান নিঃশেষ হয়ে যায় রাস্তায়, আবার কখনো নববিবাহিত কেউ অকালে প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনার এই মর্মান্তিক খবরগুলো আমাদের জীবনের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। যেন ঘুম থেকে উঠে খবর শুনি, দুঃখ পাই, আবার ঘুমিয়ে পড়ি—এটাই যেন রুটিন হয়ে গেছে!


করোনা মহামারী আমাদের জীবনে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছিল, কিন্তু বরাক উপত্যকায় সড়ক দুর্ঘটনার হার এখন যেন তার থেকেও বড় এক মহামারী হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু অনিবার্য, একথা আমরা জানি, কিন্তু অকাল মৃত্যু—এটি যে কতটা বেদনাদায়ক, তা শুধু সেই পরিবারগুলোই জানে, যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে।


সড়ক দুর্ঘটনার আসল কারণ: আমাদেরই দায়িত্বহীনতা


আমাদের চারপাশে লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশের গাড়ি বা সরকারি বাস খুব কমই দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাহলে কেন বেশি দুর্ঘটনা হয় বাইক, অটো, টুকটুকি ও প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে?


এর প্রধান কারণ হলো—অযোগ্য চালক এবং অবহেলা। বরাক উপত্যকায় ১০০ জন চালকের মধ্যে প্রায় ৭০ জনের লাইসেন্স কোনো পরীক্ষা ছাড়াই তৈরি হয়েছে। হাজারো দালাল ৬-৭ হাজার টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স বানিয়ে দিচ্ছে, অথচ এই চালকদের বেশিরভাগেরই গাড়ি চালানোর মৌলিক দক্ষতা নেই।


অপরদিকে, অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানের আবদার রাখতে গিয়ে কম বয়সেই বাইক কিনে দিচ্ছেন, অথচ সেই সন্তান আদৌ গাড়ি চালাতে জানে কিনা, তা যাচাই করার সময় নেই। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যখন একটি শিশু বাইক বা স্কুটি হাতে পায়, তখন দোষ কার? সন্তানের, নাকি বাবা-মায়ের?


অনেকেই অর্থের অভাবে কয়েকদিন ড্রাইভিং শেখার পরই টুকটুকি বা অটো নিয়ে রাস্তায় নামে। অথচ সঠিক প্রশিক্ষণ ছাড়া এই বিপজ্জনক রাস্তায় নেমে পড়া মানেই মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো।


আর প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা তো প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। আজকাল মানুষের হাতে কিছু টাকা এলেই প্রথম চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা—সে উপার্জন হালাল হোক বা হারাম, তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই! শো-অফের জন্যই যেন এই গাড়ি কেনা হয়, অথচ এই অহংকারের গাড়িই একদিন তার জীবনের শেষ যাত্রার বাহন হয়ে দাঁড়ায়।


সরকারের করণীয়


এই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে:


1. প্রত্যেকটি ড্রাইভিং লাইসেন্স কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে—কেউ যাতে বিনা পরীক্ষায় লাইসেন্স না পায়।


2. দালালদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে, যেন তারা আর কাউকে অবৈধ লাইসেন্স দিতে না পারে।


3. ট্রাফিক আইন সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে কোন সড়কচিহ্নের কী মানে, কোথায় ওভারটেক করা যায়, কোথায় করা যায় না।


4. অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে—১৮ বছরের নিচে কেউ যেন গাড়ি না চালাতে পারে।


5. প্রশিক্ষিত ড্রাইভার তৈরির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, যেন চালকেরা শুধুমাত্র চাকরির তাগিদে নয়, দায়িত্বশীলতা নিয়েও গাড়ি চালায়।


আমাদের সচেতনতা: জীবন একটাই, আর কখনো তা ফিরে পাওয়া যাবে না


প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমি আপনাদের হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করছি—বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালাবেন না, বিনা হেলমেটে বাইক চালাবেন না! গাড়ি চালানোর সময় একবার ভাবুন—আপনার জীবনের মূল্য আছে, আপনার পরিবার আপনাকে হারালে ধ্বংস হয়ে যাবে।


কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে, যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কারো হাতে গাড়ি দেখেন, তাহলে প্রতিবাদ করুন। কারণ, আজ আপনি চুপ থাকলে, কাল হয়তো আপনার প্রিয়জনকেই এই রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে হবে।


আমি যখন দুর্ঘটনার ভিডিও দেখি—কারো হাত-পা উড়ে গেছে, কারো মাথার মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে—তখন সত্যি আর কিছু গলায় নামাতে পারি না, শুধু চোখের জল ফেলি। আমি চাই না, আপনাদের কেউ এই পরিস্থিতির শিকার হোক।


আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন, এবং আমাদের সচেতনতা দিন, যেন আমরা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুর কারণ না হই। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু অকাল মৃত্যু যেন আর কাউকে স্পর্শ না করে—এই দোয়া করি।

Comments